শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত মাগুরা গ্রুপের মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং ও পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। এই দুটি কোম্পানির মোট পরিশোধিত মূলধন ২০ কোটি টাকার কম হলেও গ্রুপটির বিভিন্ন কোম্পানিতে সরানো হয়েছে ৫৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এরমধ্যে বিনিয়োগের নামে বিনাসুদে গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে দেওয়া হয়েছে ২৮ কোটি টাকার বেশি। অথচ কোম্পানি দুটি নিজে ঋণে জর্জরিত হওয়ায় মুনাফার প্রায় পুরোটাই চলে যাচ্ছে ব্যাংকের পকেটে।
এছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানি দুটি থেকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানিতে বিনিয়োগ ও বাকিতে বিক্রি করা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এখন প্রায় মৃত। যা থেকে অর্থ ফেরতের অনিশ্চয়তা রয়েছে।
সাধারান বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে গ্রুপের অন্যান্য কোম্পানিতে এ জাতীয় অর্থ পাচার প্রতিরোধে গত বছর শক্ত অবস্থান নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। যার আলোকে অনেক কোম্পানি টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। তবে সেটার মনিটরিংয়ের অভাবে পেপার প্রসেসিং ও মনোস্পুল পেপারের মতো অনেকে এখনো বিনিয়োগকারীদেরকে ঠকাচ্ছে।
দেখা গেছে, মনোস্পুল পেপার থেকে তালিকাভুক্ত পেপার প্রসেসিং ছাড়া গ্রুপটির ৩ কোম্পানিতে বিনাসুদে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের নামে ফেলে রাখা হয়েছে ২৮ কোটি ৬ লাখ টাকা। এরমধ্যে পার্ল পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলসে ২৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, মাগুরা পেপার মিলসে ৭৮ লাখ টাকা ও বাংলাদেশ নিউজ অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডে ৬৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এই বিনিয়োগের বিপরীতে মনোস্পুল পেপার কোন রিটার্ন পাচ্ছে না। এটাকে বিনাসুদে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাধারন শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ব্যক্তিগত কোম্পানিতে সরবরাহ বলা যেতে পারে। এতে উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন সাধারন বিনিয়োগকারীরা। কারন যেসব কোম্পানিতে সরানো হয়েছে, সেগুলোতে সাধারন বিনিয়োগকারীদের মালিকানা নেই। অথচ মনোস্পুলে ৪৬ শতাংশের বেশি মালিকানা রয়েছে সাধারন বিনিয়োগকারীদের।
মনোস্পুল পেপার গ্রুপের অন্যসব কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বললেও অন্যরা সেটাকে দীর্ঘমেয়াদি দায় হিসাবে দেখাচ্ছে। যেখানে শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়নি। ফলে মালিকানায় কোন অংশ নেই। যদি শেয়ারে বা মালিকানায় বিনিয়োগ করা হতো, তাহলে আনুপাতিক হারে ওইসব কোম্পানির মুনাফা রিটার্ন হিসাবে পাওয়া যেত।
এদিকে বিনিয়োগ ছাড়া শেয়ারবাজারের এই দুই কোম্পানি থেকে মাগুরা গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে বাকিতে বিক্রি বাবদ ফেলে রাখা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এরমধ্যে পেপার প্রসেসিং থেকে মাগুরা গ্রুপের ১৪ কোম্পানিতে বাকিতে বিক্রি বাবদ পড়ে রয়েছে মোট ১৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এছাড়া বাকিতে বিক্রি বাবদ ৮ কোম্পানিতে (পেপার প্রসেসিং ছাড়া) মনোস্পুলের ৮ কোটি ৯ লাখ টাকা ফেলে রাখা হয়েছে।
পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ও মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে ওই বিনিয়োগ ও বাকিতে বিক্রির তালিকায় রয়েছে একই গ্রুপের অতি ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ নিউজ অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড। এই কোম্পানিটি মূলত সংবাদ মাধ্যমের জন্য। কোম্পানিটির অধীনে বাংলাদেশের খবর, দিন পরিবর্তন ও বাংলাদেশ নিউজ নামের ৩টি গণমাধ্যম প্রকাশিত হত। যেগুলো এখন মৃতপ্রায়। যাতে বাকিতে বিক্রিবাবদ টাকা আদায়ে খুবই শঙ্কা থাকা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ নিউজ অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডে ২ কোটি ৬২ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে পেপার প্রসেসিংয়ের। এছাড়া মনোস্পুল পেপারের পাওনা টাকার পরিমাণ ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এছাড়াও মনোস্পুল পেপার থেকে ৬৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এই বিশাল অর্থ গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে ফেলে রাখার বিপরীতে মাগুরা গ্রুপের দুই কোম্পানিতে (মনোস্পুল পেপার ছাড়া) পেপার প্রসেসিংয়ের বকেয়া আছে ৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা। আর একই গ্রুপের ৪ কোম্পানি মনোস্পুলের কাছে পাবে ৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন……
বিবিএসের মূল ব্যবসায় লোকসান: সহযোগির বোনাস শেয়ার বেচেঁ নিট মুনাফা
নিজেদের গ্রুপের অন্যসব কোম্পানিকে লাভবান করতে গিয়ে তালিকাভুক্ত পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ও মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিংকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে গ্রুপটির কর্তা-ব্যক্তিরা। এই কোম্পানি দুটি থেকে অন্যত্র অর্থ সরিয়ে নিয়ে ঋণে জড়ানো হয়েছে। যাতে করে ওই ঋণের সুদ বহন করতে গিয়ে মুনাফায় দূর্বল হয়ে পড়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানি দুটি।
দেখা গেছে, গত ৩১ ডিসেম্বর মনোস্পুলের ঋণের পরিমাণ দাড়িঁয়েছে ৭৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এরমধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ৪২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ও স্বল্পমেয়াদি ৩২ কোটি ৫৬ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। আর ৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকার দীর্ঘমেয়াদি ও ২০ কোটি ১৪ লাখ টাকার স্বল্পমেয়াদিতে পেপার প্রসেসিংয়ের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি দুটির মোট ঋণের পরিমাণ ১০৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
এই বিশাল ঋণের কারনে সুদজনিত ব্যয়ও হচ্ছে অনেক। যাতে মুনাফায় বড় ধাক্কা লাগছে। যেমন মনোস্পুল পেপারের চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর ২১) উচ্চ সুদজনিত ব্যয়ের কারনে ৭ কোটি ৫ লাখ টাকার পরিচালন মুনাফা কমে ১ কোটি ৭ লাখ টাকার নিট মুনাফা হয়েছে। ওইসময় কোম্পানিটির সুদজনিত ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বিজনেস আওয়ার২৪.কমকে বলেন, সাধারন বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ব্যক্তিগত কোম্পানিতে অর্থ সড়ানো কোনভাবেই মেনে নেওয়া ঠিক হবে না। এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রকসংস্থাগুলোর শক্ত অবস্থান নিতে হবে। একইসঙ্গে অর্থ ফেরত আনা নিশ্চিত করে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
একই বিষয়ে জানতে ডিএসইর ওয়েবসাইটে কোম্পানির প্রোফাইলে যোগাযোগ করার মতো কারও নাম্বার পাওয়া যায়নি। অথচ প্রতিটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রোফাইলে কোম্পানি সচিবের নাম ও তার ফোন নাম্বার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রদত্ত ঠিকানায় মেইল করেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ওভার দ্য মার্কেটে (ওটিসি) ছিল মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং ও পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। তবে গত বছরের ১৩ জুন কোম্পানি দুটির শেয়ার লেনদেন মূল মার্কেটে শুরু হয়েছে। এরপর থেকেই শেয়ার দুটি নিয়ে শুরু হয় কারসাজি। যাতে করে অস্বাভাবিক হারে বাড়ে শেয়ার দর।
বিজনেস আওয়ার/০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২/আরএ
One thought on “মনোস্পুল পেপার-পেপার প্রসেসিং ঋণে জর্জরিত: গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনাসুদে অর্থ প্রদান”